কাত্তিক দাস, নড়াইলঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় রাজাকার খলিল শেখের সহযোগিতায় পাক সেনারা আমার বাবা কুমুদ রায়কে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে নবগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়। তখন বয়স আমার প্রায় ১২ বছর । অনেক খোজ করে বাবার লাশ পাইনি । সংসারে মা ও দুই বোন । তাদের বাচাতে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে লঞ্চে লঞ্চে কলা,বিস্কুট,পাউরুটি বিক্রি করে সংসার চালাইছি । অনেক দিন খেয়ে না খেয়ে দিন কেটেছে । এক পোয়া আটা কিনে পাতলা জাউ রান্না করে সবাই মিলে খেয়েছি । কচু ঘোটা খেয়েছি । বাজার থেকে শাক–পাতা কুড়িয়ে তেল লবন ছাড়াই সেদ্ধ করে খেয়েছি । অনেকের কাছে হাত পেতেছি । কোনো সহায়তা পাইনি । অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছি । মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দু:সহ কথাগুলো বলতে গিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন শিবুপদ রায় (৫৮) । লঞ্চের কলা বিক্রেতা এখন কোটিপতি । মৎস্য চাষীসহ বিশাল কৃষি খামারের মালিক । শুধু তাই নয় কালিয়া পৌর সভার ৬ নস্বর ওয়াডের একাধিকবার নিবাচিত কাউন্সিলরও । তিনি বলেন,এখন আমার ভাত পরে খায় । শিবুপদ রায়ের বাড়ি কালিয়া পৌর সভার ছোট কালিয়া গ্রামে ।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে,কালিয়া উপজেলা শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে গোবিন্দনগর গ্রামের ভক্তডাঙ্গা বিলের দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার । এখানেই শিবুপদ রায় ২৬৭ একর জমির ওপর গড়ে তুলেছেন মৎস্যসহ সমন্বিত কৃষি খামার । খামারে টমেটো,মিষ্টি কুমড়া,ঢেড়স,পেপে,করোলা,লাউসহ বিভিন্ন শাক–সবজির আবাদ করা হচ্ছে । পাশাপাশি বিশাল ঘেরে চিংড়ি, বিভিন্ন প্রজাতির সাদা মাছ চাষাবাদসহ আমন ও বোরো ধানের আবাদ করা হচ্ছে । শিবপদ রায় নিজেই শ্রমিকদের সঙ্গে খামারের পরিচযা করছেন । এসব কৃষিপণ্য রাজধানী ঢাকাসহ পাশের গোপালগঞ্জ,মাদারীপুর,বাগেরহাট,খুলনা,বরিশাল,ফরিদপুর,মাগুরার বিভিন্ন হাট–বাজারে বিক্রি হচ্ছে । এখানে ২২ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন এবং এক থেকে দেড়’শ জন শ্রমিক খন্ডকালীণ কাজ করে থাকে । এই খামার থেকে বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার কৃষিপণ্যসহ মাছ বিক্রি করা হয় । পণ্য পরিবহন খরচ,শ্রমিক,ইজারা নেওয়া জমির মালিকদের টাকা পরিশোধ করে শিবুপদ রায়ের বছরে লাভ থাকে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা ।
যেভাবে গড়ে তোলা হয় খামার
লঞ্চে লঞ্চে কলা,বিস্কুট,পাউরুটি বিক্রি করে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ টাকা আয় হতো । এ টাকা দিয়ে সংসার চালাতাম । লঞ্চেই একদিন আমার দেখা হয় বড়দিয়া মোকামের (বড়দিয়া নৌ–বন্দর)ভূষিমাল ব্যবসায়ী নিত্যানন্দ সাহার সঙ্গে । তিনি কাছে ডেকে আমার কষ্টের কথা শুনে তার গদিতে (ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে) থাকা–খা্ওয়াসহ মাসে ৩০০ টাকা বেতনে কাজ করার সুযোগ দেন । সাত বছর দোকানে কমচারীর কাজ করেও অষ্টম শ্রেণি পযন্ত লেখাপড়া করেছেন তিনি । সবশেষ ৭ হাজার টাকা পযন্ত বেতন পেয়েছেন । বেতনের টাকা জমিয়ে ১৯৭৮ সালের দিকে কালিয়া পৌর এলাকায় ১৬ হাজার ৬০০ টাকা পুজি নিয়ে ভূষিমালের দোকান দেন । ১৯৯৮ সালে ১০ একর জমি বন্দোবস্ত নিয়ে বাড়ির পাশে চিংড়িমাছের চাষ করেন । তখন আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার । ঘেরের পাশাপাশি ধানছাটাই মেশিন (রাইচমিল)কেনেন । ২০১৫ সালে ভক্তডাঙ্গা বিলেই সমন্বিত কৃষি খামার গড়ে তোলেন । প্রথমে ২২৬ একরে পরে তা বাড়িয়ে ২৬৭ একর জমিতে চাষাবাদ করে আসছেন । এ বছর ১০০ একর জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন ।
খামারে খরচ যেমন
ভক্তডাঙ্গার বিল সারা বছরই পানিতে তলিয়ে থাকে । ফসলাদি তেমন একটা হতো না । এ সমস্ত জমির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে ২০ বছর চুক্তিতে তাদের জমি বন্দোবস্ত নেওয়া হয় । এ রকম প্রায় ৫০০ কৃষকের জমি বন্দোবস্ত নেওয়া হয় । জমির মালিকদের (জমির পরিমাণ অনুযায়ী) বছরে দিতে হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা । এছাড়া রয়েছে নিয়মিত এবং অনিয়মিত শ্রমিকদের টাকা ।
ব্যবসায়ী ও এলাকার মানুষের কথা
ছোট কালিয়া গ্রামের অশোক কুমার ঘোষ বলেন, পৌর কাউন্সিলর হয়েও শিবুপদ রায় কৃষিক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছে তা অনুকরণীয় । তার খামারে ঘেরের পাশাপাশি সারা বছরই কিছু না কিছু ফসল চাষ হচ্ছে । প্রতিদিনই তিন থেকে চার ট্রাক মালামাল এই খামার থেকে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাচ্ছে ।
বাগেরহাটের কাচামাল ব্যবসায়ী ছলেমান মোল্লা, বলেন, সপ্তাহে তিনি এখান থেকে এক ট্রাক বিভিন্ন শাক–সবজি,টমেটো,মিষ্টি কুমড়া,পেপে,ঢেরসসহ অন্যান্য মালামাল নিয়ে থাকি । বিষ এবং ফরমালিনমুক্ত হ্ওয়ায় এখানকার সবজির চাহিদা রয়েছে । ফরিদপুরের আসলাম শেখ এবং খুলনার আশীষ মালো দুজনই মাছ ব্যবসায়ী । তারা বলেন,তিন দিন পর পর এখান থেকে তারা এক ট্রাক করে চিংড়িসহ বিভিন্ন সাদা মাছ নিয়ে থাকেন ।
কৃষি কর্মকর্তাদের কথা
কালিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুবির কুমার বিশ্বাস বলেন,পরীক্ষা করে দেখেছি শিবুপদ রায়ের খামারের সব কিছু বিষ এবং ফরমালিনমুক্ত। যার কারণে এই খামারের সব কিছু বাজারে চাহিদা রয়েছে ।
উপজেলা মৎস্য কমকতা রাজিব রায় বলেন,প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ মণ চিংড়ি,১০ থেকে ১৫ মণ অন্যান্য মাছ বিক্রি করা হয়ে থাকে ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নড়াইল কাযালয়ের উপ পরিচালক প্রবীর কুমার এটিএন টাইমসকে বলেন,২৬৭ একরের এ বহুমুখি খামারটি নয়নাভিরাম এবং দৃষ্টি নন্দন । তিনি বলেন,জীবনে অনেক স্থানে চাকরি করেছি, কিন্তু গোছালো এবং পরিস্কার–পরিচ্ছন্ন এমন কৃষি খামার কোথা্ও চোখে পড়েনি । এটি শুধু অনুকরণীয়ই নয় আমাদের দেশে একটি মডেল হতে পারে ।