রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরাঙ্গনা পুষ্পরানী শুক্লবৈদ্যর দাহ সম্পন্ন

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরাঙ্গনা পুষ্পরানী শুক্লবৈদ্যর দাহ সম্পন্ন

শেয়ার করুন

৭১ এ ৯জনকে জীবন্ত দগ্ধ করে পুস্প ও তার জা কে নিয়ে যায় পাক সেনারা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনা পুষ্পরানী শুক্লবৈদ্যর দাহ সম্পন্ন

।। আব্দুল হালীম, হবিগঞ্জ ।।

১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধের বীরবীরঙ্গনা পুষ্পরানী শুক্ল বৈদ্যের মৃতদেহ রাষ্ট্রীয় সম্মাননার পর পারিবারিক শ্মশানে দাহ সম্পন্ন করা হয়েছে। (৮ আগস্ট) দুপুর ১২ টায় চুনারুঘাট উপজেলার সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মিল্টন চন্দ্র পালের উপস্থিতিতে চুনারুঘাট থানার এসআই দেওয়ান সম্রাটসহ একদল পুলিশ রাষ্ট্রীয় সালাম প্রদান করেন।

এসময় স্থানীয় চেয়ারম্যান আবেদ হাসনাত চৌধুরী সনজু , মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস ছামাদ, সন্তান কমান্ডের সভাপতি আব্দুস ছালাম পরিবারের লোকজন উপস্থিত ছিলেন। নিহত পুষ্পরানী শুক্লবৈদ্যের নাতী স্থানীয় আহম্মদাবাদ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাহুল শুক্লবৈদ্য জানান, ৩দিন পুর্বে বার্ধক্যজনিত কারনে অসুস্থ হলে তাকে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে ৭ জুলাই মধ্যরাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Puspo Rani 1

মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল (৭৮)বছর। তিনি ২০১৪ সালে প্রথম আলো সহ অনেক সম্মাননায় ভুষিত হন।তার মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন,সাবেক এমপি আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী,চুনারুঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আঃ কাদির লস্কর, সাবেক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী আব্দুর রহমান, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাজী আব্দুল লতিফ ।
উল্লেখ্য ১৯৭১ এ পাক বাহিনীর তান্ডবে তছনছ করে দেয় বিরঙ্গনা পুস্পরানীর সুখের সংসার। ওই দিন বাড়িতে লোকজনকে বেধে আগুন দিয়ে ৯জনকে জীবন্ত দগ্ধ করে হায়েনারা। এতেও শান্ত হয়নি তারা। নিয়ে যায় পুস্প ও তার জা মালতিকে নিয়ে দিনের পর দিন তাদের লালসা মেটায়।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার আহমদাবাদ ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গোছাপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী রাখাল চন্দ্র শুল্ক বৈদ্যের স্ত্রী পুস্পরানী শুল্ক বৈদ্য ২ সন্তান নিয়ে ভালই দিন কাটছিল। রাখালের পরিবারের ছিল এলাকায় বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি।
৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে আশপাশের লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে ভারত ছুটছিল। তখন রাখাল চন্দ্রের মা সুখমীয় শুল্ক বৈদ্য বাধ সাধেন। তিনি বলেন, মরতে হলে নিজের ভূমিতেই প্রাণ দিব। যে কারনে এ পরিবারের কারোরই ভারত যাওয়া হয়নি।

জৈষ্ঠ মাসের ১২ তারিখ। গভীর রাতে পাক হানাদার বাহিনী তাদের বাড়িতে হানা দেয়। অক্ষয় চন্দ্র শুক্ল বৈদ্য ঘুম থেকে উঠেছিলেন গোয়ালঘরে গরু-বাছুরদের খাবার দিতে। বাড়ির আঙিনায় অবস্থান করা হানাদারদের হাতে আটক হন তিনি। এরপর ঘরের দড়জা ভেঙে রাখাল চন্দ্রকে টেনে-হেচড়ে বের করে পাক আর্মির সদস্যরা। তাদেরকে বেধে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো দুটি জিপের পাশে নিয়ে যায়। জীপের রডের সাথে বেধে গাড়ি চালিয়ে পার্শ্ববর্তী পাল বাড়ির সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে অক্ষয় চন্দ্র শুক্ল বৈদ্য ও যতীন্দ্র রাম শুক্ল বৈদ্যকে হত্যা করে। গুলির শব্দ শুনে বাড়ি থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে অক্ষয় চন্দ্রের বড় ছেলে টেনু (১৬) প্রাণ হারায়। একই সময়ে পাক আর্মি হত্যা করে পাল বাড়ির বিপিন পাল, হরেন্দ্র পাল, ব্রজেন্দ্র পাল ও একজন পুরহিতকে, তার নাম জানা যায়নি। এরপর তাদেরকে খড়ের ঘরের সাথে বেধে সেই ঘরে আগুন দেয়। মৃত্যু নিশ্চিত করতেই আগুনে পুড়িয়ে অঙ্গার করে গুলিতে প্রাণ হারানোদের। এর পর পাকবাহিনী পার্শ্ববর্তী মীর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়া পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আটক করে সুখদেবপুরে নিয়ে যায়। ওই গ্রামে পাক বাহিনীর অনুসারি রশিদ মিয়ার বাড়িতে সকলকে জিম্মায় রাখে।

শঙ্কা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা এবং শোকে মুহ্যমান থাকলেও অন্যান্যদের সাথে রশীদ মিয়ার বাড়িতে তাদের দুর্বিসহ দুটি দিন কেটে যায়। তৃতীয় দিন দুপুরে একটি জীপে করে চার পাকসেনা আসে রশিদ মিয়ার বাড়িতে। তারা আটককৃতদের সবাইকে উঠোনে এনে দাঁড় করিয়ে শুধুমাত্র পুস্প ও মালতিকে নিয়ে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় দুর্গাপুর এলাকার একটি বাড়িতে নিয়ে রাখে। ওই সময়ের পুস্প রানীর বয়স ছিল বিশ বছর। পাক সেনারা তাদের শরীর নিয়ে উন্মত্ততায় মেতে উঠে। প্রথম দিন চারজন পাকসেনা লালসা মেটায়। এদেশীয় দোসরেরাও নির্যাতনে শামিল হয়। দীর্ঘদিন দূর্গাপুরে নির্যাতিত হন তারা। অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করলেও মুক্তি মেলেনি তাদের। এই এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে এলে মুক্তিপান দু’জা। মুক্তি পেয়ে দু’জনই চলে বাপের বাড়িতে। সেখান থেকে ফিরে আসেন স্বামীর ভিটায়। এদিকে বাড়ির অন্য ৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া গেলেও রাখাল বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি আজও। পুস্পরানী মুক্তিযুদ্ধের পর একযুগ স্বামীর জন্য সিথিতে সিদুর পড়েছেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রচলিত রীতি অনুযায়ি কোন স্বামী যদি ১২ বছর নিরুদ্দেশ থাকেন তাহলে তাকে মৃত বলেই ধরে নেওয়া হয়। রাখাল শুক্ল বৈদ্যকেও সনাতনী বিধান অনযায়ি মৃত বলে ধরে নেওয়া হলো। ১৯৮৫ সালে রাখাল শুক্ল বৈদ্যের ছেলেরা বড় হলে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের বেদনা ভুলে ঘুরে দাড়িয়েছেন পুষ্প রাণী। তাঁর দুই ছেলে মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। দুই ছেলেকেই বিয়ে করিয়েছেন। বৈদেশিক রেমিটেন্স এবং স্বামীর প্রাপ্ত সম্পত্তি সব মিলিয়ে বেশ ভালোভাবেই দিন কাটছে তাঁর।